ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ:
রেমিটেন্স বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত – গার্মেন্টস খাতের পরপরই রেমিটেন্সের স্থান। আর এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাঙ্গা রেখে অর্থনীতিতে গুরুতপূর্ন অবদান ও ভুমিকা রাখেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটিরও অধিক প্রবাসীরা। আর এই প্রবাসীদের নিয়ে বেশ কিছু ন্যাক্কারজনক ঘটনা সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘটেছে যা খুবই দু:খজনক ও উদ্বেগজনক। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখার বা চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। সরকারের উচিত ছিল শক্ত হাতে এ ব্যাপারটি হ্যান্ডল করা যেমনটি বৃটিশ সরকার করেছিল। করোনা ভাইরাস ইউকে’তে ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে বৃটেনে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদের উপর কয়েকটি চোরাগুপ্তা হামলা ও আক্রমণ হয়েছিল। বৃটিশ সরকার শক্তহাতে তা দমন করার কারনে তাৎক্ষনিকভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রবাসীদের সাথে এই ধরনের ন্যাক্কারজনক আচরনের সুদুরপ্রসারী প্রভাব সরকার কি ভেবে দেখছেন? বিশ্ব মহামারীর পর অনিবার্যভাবে ধেয়ে আসা বিশ্ব অর্থনীতির মন্দায় ও দূর্ভিক্ষে প্রবাসীরা যদি রেমিটেন্স প্রবাহ বন্ধ করে দেয় বা উল্লেখযোগ্য হারে তা কমিয়ে দেয় তখন দেশের অর্থনীতির কি ক্ষতি হতে পারে তা কি একবার তলিয়ে দেখছেন? প্রবাসীদের সাথে এমন অমানবিক আচরনে কোটি প্রবাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরন হয়েছে। কেঁদে কেঁদে অনেক প্রবাসী তাদের তীক্ত অভিজ্ঞতা বর্ননা করেছেন এবং বলেছেন যাদেরকে বছরের পর বছর টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছি, তাঁরাও আমাদের চরম শত্রু ভাবছে। এর রেশ অনেক দিন চলবে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের প্রতি এর নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদুরপ্রসারী।
বিশ্বে মহামারী শুরু হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সরকার চাইলেই দেশে আসা প্রবাসীদের ব্যাপারে সুন্দর একটা ব্যবস্থাপনা করতে পারতো। প্রবাসীরাতো আকাশ থেকে উদ্ভব হন নাই বা মাঠির নীচ থেকেও উঠে আসেন নাই। তারাতো দেশের এয়ারপোর্ট (প্রধানত: একটি এয়ারপোর্ট দিয়েই) দিয়েই দেশে প্রবেশ করেছেন। সুতরাং তাদের সঠিক হিসাব বা তাদের বিষয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা করা কোন ব্যাপারই ছিল না। “অন এরাইভাল” তাদের প্রত্যেককে কেন সঠিকভাবে টেস্ট করা হলো না? কেন তখনই সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এয়ারপোর্ট থেকেই তাদেরকে বাধ্যতামূলেক কোরেনটাইনে নেয়া হলো না? ঢাকার কয়েক ডজন আবাসিক হোটেল রিকুইজেশনের মাধ্যমে সরকারের আয়ত্বে এনে এবং ওখানে প্রবাসীদের রেখে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তখন সহজেই কঠোরভাবে কোরেনটাইন পালনে বাধ্য করা যেত।
সরকার করবে কিভাবে? গত জানুয়ারীতে যেখানে এগুলো করার কথা তখন প্রায় অর্ধ ডজন মন্ত্রী মহোদয় হাস্যস্কর, খামখেয়ালী, চরম ঔদ্ধত্যপূর্ন, অবিবেচক ও দৃষ্টিকঠু কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিলেন। আর এয়ারপোর্টে এ সংক্রান্ত ব্যাপারে দায়িত্বে রাখা হয়েছিল দৃশ্যত কিছু কর্মচারী/কর্মকর্তাদের যারা ৫০০ টাকার বিনিময়ে করোনা ভাইরাস নাই বলে সনদ দিচ্ছিল বা টাকা না দিলে ১৪ দিনের খামোখা (অযথা) কোরেনটাইনে পাঠাচ্ছিল বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছিল। কিছু কিছু ভুক্তভোগী যাত্রীরা তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা সোসাল মিডিয়ায় আপলোডও করেছেন। যা সহজেই করা যেত, যা যথাযথভাবে ও কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রন করা যেত, তা না করে অযথা প্রবাসীদের দুষ দিয়ে কি লাভ হবে!
মাননীয় পররাস্ট্র মন্ত্রীর কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কেননা দীর্ঘদিন তিনি নিজেও প্রবাসী ছিলেন। কিন্তু তাঁর ভূমিকায় আমাদের আবারও স্মরন করিয়ে দিল সেই ঐতিহাসিক প্রবাদের কথা “যে যায় লংকায় সেই হয় রাবন”! তিনি কিভাবে প্রবাসীদের নিয়ে মিডিয়ায় মারাত্মক আপত্তিকর মন্তব্য করে বললেন “প্রবাসীরা দেশে আসলে নবাবজাদা বনে যান”? প্রবাসীদের নির্যাতন ও নাজেহালের ক্ষেত্রে তাঁর এ মন্তব্য হয়েছে অনেকটা “আগুনে ঘি ঢালার মত”। কেননা তাঁর এই আপত্তিকর উক্তি থেকে দেশের সাধারন মানুষ ও বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্টী প্রবাসীদেরকে নাজেহাল ও তূচ্চতাচ্ছিল্য করতে উৎসাহ ও সাহস পেয়েছে। তাঁর এ কথার দৃশ্যত: নেতিবাচক দিক বিবেচনা করে নিজ থেকে দু:খ প্রকাশ করা তো দুরের কথা, কিছুদিন পর মিডিয়ায় তিনি সদর্পে ঘোষনা করলেন “করোনা ভাইরাসে মৃত্যু হওয়া প্রবাসীদের লাশ দেশে আসতে দেয়া হবে না”। অথচ তাঁর তো জানা উচিত ছিল করোনা ভাইরাসে কারো মৃত্যু হলে কঠোর বিধিমালার আওতায় স্থানীয়ভাবে দাফন করতে হয়, পরিবারের অনেক সদস্যরাও দাফন-কাফন এবং জানাযায় যোগ দিতে পারেন না। দেশের বাহিরে লাশ পাঠানো বা অন্য দেশে লাশ আনার কথা চিন্তাই করা যায় না। কোন এয়ারলাইন্স বা কার্গো বিমান সেই লাশ বহন করবে না। এটা তো মন্ত্রী মহোদয়ের অজানা থাকার কথা নয়। তিনি চাইলেও করোনা ভাইরাসে মৃত কোন ব্যক্তির লাশ বিদেশ থেকে দেশে আনতে পারতেন না। তাহলে অতিউৎসাহী হয়ে প্রবাসীদের ব্যাপারে এ ধরনের উক্তির হেতু কি?
তাছাড়া শুধু প্রবাসীরাই কি বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে আসছেন? বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে কত হাজার হাজার বিদেশী নাগরিক প্রতিমাসে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসেন। আবার সরকারী কাজে কত শত শত কর্মকর্তা প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ সফর করতে হয়। প্রবাসী বাংলাদেশী ছাড়া এরাও তো বিদেশ থেকে করোনা ভাইরাস দেশে নিয়ে আসতে পারেন? তাই কাকে দুষবেন? শুধু প্রবাসীদের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে কেন অবমাননাকর ও অপমানজনক কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে বা চলতে দেয়া হচ্ছে? পৃথিবীর আর কোন দেশে তার দেশের প্রবাসীদের সাথে এমন আচরন করা হচ্ছে না। বরং বিভিন্ন দেশ এই মহামারীর সময়েও চার্টার্ড প্লেনে তথা বিমান ভাড়া করে বিদেশে আটকা পড়া তার দেশের নাগরিকদের দেশে ফিরত আনছে।
প্রবাসীদের দুষ দিয়েই যদি সবকিছুর সুন্দরভাবে সমাধান হয়ে যেত, তাহলে হয়তো তা কষ্ট করে হলেও মেনে নেয়া যেত! কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি? আভ্যন্তরীন প্রস্তুতিটাওতো সন্তোষজনক বলে মনে হল না। সাধারন ছুটি ঘোষনা করা হলো কিন্তু প্রথম কিছুদিন দুরপাল্লার যান বা রেল বন্ধ করা হলো না। তাতে লাভ হলো কি? শহর/নগর, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে/মফস্বলে গিয়ে ছোঁয়াছে ভাইরাসটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল। ভাবছেন, এর সুদুর প্রসারী পরিনাম!
অনেক বাগাড়ম্বর করলেও এখন একটা মন্ত্রী মহোদয়কেও রাস্তায় দেখা যায় না। অথচ অল্প কিছুদিন আগে তাদেঁর কি না দম্ভ ছিল! পশ্চিম বঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বনার্জি নিজে রাস্তায় নেমে মানুষদেরকে লকডাউন মানতে উদ্বুদ্ধ করছেন। একটু হলেও মমতার দিদির কাছ থেকে শিখে মাননীয় মন্ত্রী ও এমপি মহোদয়রা রাস্তায় নামুন না! জনগনকে সচেতন করুন। আর আসুন আমরা একসাথে ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্বব্যাপী মহামারীর অপ্রতাশীত ও অভাবনীয় চ্যালেন্জকে মোকাবিলা করি। প্লিজ, অযথা প্রবাসীদের অপমান ও দুষাদুষী করে তাদের দূরে ঠেলে দিবেন না। দুর্দিনে প্রবাসীরা দেশের পাশে ছিল, ভবিষ্যতেও তারা দেশের পাশে থাকবে। তাদের সততা ও দেশপ্রেম প্রমানিত ও পরীক্ষিত।
লেখক: বিলেতে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, বিশ্লেষক, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ও লন্ডনের নিউহ্যাম কাউন্সিলের ডেপুটি স্পিকার।